অণু গল্প -মুক্তার মুক্তি

মুক্তার মুক্তি
-অঞ্জনা গোড়িয়া

 

কলেজের ডানপিটে,স্বাধীনচেতা, দাপিয়ে বেড়ানো মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। আজ সে কূলবধু।
বধূর সাজে সজ্জিত এক লক্ষ্মীমন্ত বউ। ঘরের জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে সারাক্ষণ। দু’টি চঞ্চল নয়ন ছুটে যায় সেই মেয়েবেলায়। মায়ের শাড়ি লুকিয়ে পড়ে, বউ সাজা। বন্ধুদের সাথে বর -বউ খেলা। সিঁদুর পড়ে বউ সাজা। আর মায়ের বকা খাওয়া। বেশ ছিল দিনগুলি। বউ সাজতে ওর খুব ভালোলাগতো। ও তো জানতো না সত্যিকারের বউ হলে যে কি জ্বালা। স্কুল, কলেজে তার দুষ্টু বুদ্ধির জুড়ি মেলা ভার।
বন্ধুদের সাথে কলেজ ফাঁকি দিয়ে সিনেমায় যাওয়ার কথা কি ভোলা যায়? কিংবা নদীর তীরে ঘাসের ওপর বসে কবিতা লেখা। গুন গুন করে গান গেয়ে ওঠা। নদীর বুকে নৌকায় ভেসে বেড়ানো। আজ সব স্বপ্নের মত লাগছে। কলেজটা ছিল ঠিক নদীর তীরে। তাই নদীর ছলাৎ ছলাৎ জলের ঢেউ দেখতে দেখতে মনেই থাকত না বাড়ি ফেরার কথা।
পড়া শেষ হলো না তার। ভালো পাত্রের সন্ধান পেয়ে বিয়ে হলো মুক্তার। মুক্তা সেজেগুজে দিব্যি বিয়ে করে নিল। তারপর তার হারিয়ে গেল অতীত। মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মুক্তা। কি যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। আজ সে অন্যের। অন্য এক পুরুষের। অন্য এক পরিবারের বউ।
জানালার সামনেই এক শান্ত স্নিগ্ধ দীঘি আছে। সেই দীঘিতে ফুটন্ত শালুকগুলি মাথা দুলিয়ে ডাকছে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে দীঘিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আঁচল ভরে শালুক তুলতে। ইচ্ছে করে শালুকের মালা গেঁথে গলায় পরতে। কবিতা লিখতে। আর আসে না কবিতা ওই বন্দী ঘরে। মনটা ফিরে যায় সেই ছোট বেলায়। সবই তার কল্পনা।
সে যে স্বাধীন ভারতের বউ। বউদের এসব ঠিক মানায় না। স্বামীর কড়া আদেশ বাড়ি থেকে যখন তখন বাইরে যাওয়া যাবে না। যদি কোন দিন যেতে ইচ্ছে করে তো, স্বামীর সঙ্গেই যেতে হবে। ভালো আহার, দামী শাড়ি , দামী গহনায় ঢাকা পড়লো মুক্তার মন। তবু ঢাকা পড়ে না পরাধীনতার যন্ত্রনা।

এক দিন ফোন এল তার। যার চোখে ছিল স্বপ্ন। বেঁচে থাকার শক্তি। স্বাধীনতার মন্ত্র। মুক্তির আহবান।
মুক্তা আর পিছনে ফিরে তাকাল না।
সবাই যখন ঘুমিয়ে। বন্ধ দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। সেইখানে মিলিত হলো ওরা। সেই নদীর তীরে আরও পাঁচ জন। কলেজের বন্ধু। যেখানে আগেও দেখা হতো সবার। আজ সে স্বাধীন। আজ যে স্বাধীনতা দিবস। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করল। নদীর তীরে ঘাসের উপর গিয়ে বসল ওরা। মুক্তার কবিতার খাতাটা হাতে তুলে দিল। এক দিন ওর হাতেই তুলে দিয়ে ছিল মুক্তা। এই তোর স্বাধীনতা। ইচ্ছে মতো লেখ তোর মনের যন্ত্রনা। আমরা এখন আসি। হারিয়ে গেল ওরা।
ঘুমটা ভেঙে গেল। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, জাতীয় পতাকা উড়ছে। ভেসে আসছে সেই গান,”বন্দেমাতরম “।

Loading

2 thoughts on “অণু গল্প -মুক্তার মুক্তি

Leave A Comment